মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম :
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত ঘাতকার বাঙালির এই বিজয় মেনে নিতে পারেনি। এই অপশক্তি বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে। হত্যা করে জাতীয় ৪ নেতা সহ হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল নেতা-কর্মীদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করা হয়। মানুষের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকারকে হরণ করা হয়। সীমাহীন দুঃশাসন ও নিপীড়নে অসহায় হয়ে পড়ে মানুষ। বাংলাদেশ প্রবেশ করে এক অন্ধকার যুগে।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে বাংলার জনগণকে তার ন্যায্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, প্রাণের মায়াকে তুচ্ছ করে, স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, গণতন্ত্রের মানস কন্যা, জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ফিরে আসেন প্রিয় মাতৃভূমিতে। সেদিন তাঁকে বরণ করে নিতে সমবেত লক্ষ লক্ষ জনতার উদেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘আমি সব হারিয়ে আজ আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি, শুধু আমার পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে দুখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাবার জন্য। প্রয়োজনে আমার পিতার মতো জীবন দিব, তবু আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আপোষ করবো না।”
পরবর্তীতে তাঁর সকল রাজনৈতিক কর্মকা-ে আমরা সেদিনের সেই ঘোষণার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। বিভিন্ন সময় তাঁর উপর আঘাত এসেছে। বহুবার তাঁকে হত্যার অপচেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে তার লক্ষ্য থেকে এক চুল পরিমাণও নড়াতে পারেনি। জীবনের পরোয়া না করে তিনি ফিরে এসেছিলেন বলে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক বিস্ময়কার রোল মডেল। তিনি ফিরে এসেছিলেন বলে মানুষ ফিরে পেয়েছে তার গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার। তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই আমার হয়েছি আজ আলোর পথের যাত্রী।
যে দেশটি ছিল উপহাসের পাত্র, যে দেশটিকে বলা হতো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই দেশটিকেই বদলে দিলেন তিনি জাদুকরী নেতৃত্বে। বাংলাদেশ আজ আপন মর্যাদায় বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী নেতৃত্বে সুশাসন, স্থিতিশীল অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, উন্নয়নে গতিশীলতা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে ।
এবার আসুন সংক্ষেপে দেখে নিই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুগান্তকারী অর্জন ও সাফল্যসমূহঃ
মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ৭.২৪। মাথাপিছু আয় ১৬০২ ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। ৫ কোটি মানুষ নি¤œবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ জাতীয় ৪ নেতার হত্যার বিচার করে জাতিকে কলংক মুক্ত করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। কুখ্যাত নরঘাতক নিজামী, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, সাকা চৌধুরী, আলী আহসান মুজাহিদদের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ গ্লানিমুক্ত হয়েছে।
গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পাবর্ত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন।
৬৮ বছরের অমীমাংসিত স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। সমুদ্র সীমার উপর আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শতভাগ শিশু আজ স্কুলে যায়। গত আট বছরে সর্বমোট প্রায় ২২৫ কোটি ৪৩ লাখ ১ হাজার ১২৮টি বই বিতরণ করা হয়েছে। ২৬ হাজার ২০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৫০০টি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মালিমিডিয়া ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৭৬ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার ৭২৬ মেগাওয়াট। ১১৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। পাবনার রূপপুরে ২ হাজার মেগাওয়াটের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে।
মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে গড় আয়ু ৭১ বছর ৯ মাস। শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। শতভাগ শিশু টিকা পাচ্ছে আজ। স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ৮ বছরে ১২ হাজার সহকারী সার্জন ও ১১৮জন ডেন্টাল সার্জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ১৩ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রায় সাড়ে ১২ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাকা সহ বিভিন্ন জেলায় ২৪টি নতুন সরকারি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।দেশীয় চাহিদার ৯৭% ওষুধ দেশে তৈরি হয়। বাংলাদেশ এখন ১২৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন নয় বাস্তব। ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার এবং ৮ হাজার ২০০টি ই-পোস্টের মাধ্যমে প্রতিদিন ৪০ লক্ষ মানুষ ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা পাচ্ছে। ১৩ কোটি মানুষ এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। ইন্টারনেট গ্রাহক প্রায় ৬ কোটি। ২৫হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বেও বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘তথ্য বাতায়ন’ চালু হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের পাশাপাশি সারাদেশের মানুষকে স্মাট কার্ড দেওয়া হয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর উৎক্ষেপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
যোগাযোগ খাতে ঘটেছে যুগান্তকারী বিপ্লব। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। আশা করা যাচ্ছে ২০১৮ এই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ঢাকায় ২০ কিলোমিটর দীর্ঘ মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ চলছে যা ২০১৯ সালে চালু হবে।
নয়নাভিরাম হাতিরঝিল প্রকল্প রাজধানী ঢাকাকে বদলে দিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ ৪ লেইনে উন্নীত করা হয়েছে। ঢাকা-মাওয়া সড়ক ৪ লেইনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। ৪৬.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ চলছে যা ২০২০ সাল নাগাদ সম্পন্ন হবে।
সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়িতে মেয়র হানিফ উড়াল সেতু, মিরপুর-বিমানবন্দর জিল্লুর রহমান উড়াল সেতু, কুড়িল-বিশ্বরোড বহুমুখী উড়াল সেতু, বনানী ওভারপাস, টঙ্গীতে আহসানউল্লাহ উড়াল সেতু, চট্টগ্রামে বহদ্দার উড়াল সেতু, মগবাজার-মালিবাগ-রামপুরা-শান্তিনগর উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নদীর উপর শহীদ বুদ্ধিজীবী সেতু নামে ৩য় সেতু, কর্ণফুলী নদীর উপর শাহ আমানত সেতু, শীতলক্ষ্যা নদীর উপর সুলতানা কামাল সেতু, কীর্তনখোলার নদীর উপর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবত সেতুসহ ৪৯টি বৃহৎ সেতু নির্মিত হয়েছে। ২য় মেঘনা সেতু, ২য় দাউদকান্দি সেতু ও ২য় কাচপুর সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে ২০১৮ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজ চলছে যা ২০২০ সালে সমাপ্ত হবে। ১০৬টি নতুন ট্রেন চালু হয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। ঢাকা-চট্টগ্রামে ডাবল লাইন চালু হয়েছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। জাপানের জাইকাসহ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ সম্পন্ন হলে বিদ্যুৎ খাতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশিও বিদ্যুৎ রপ্তানি করা যাবে।
সোনাদিয়া সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি গ্যাস ষ্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে সোনাদিয়া, ধলঘাটাসহ মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে শিল্প অঞ্চল সমূহে কলকারখানার চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ সারাদেশে শিল্প অঞ্চলগুলোতে পাইপলাইনের মাধ্যমে এ গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ফলে শিল্প ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সৃষ্টি এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
কক্সবাজারের বিমান বন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর নির্মাণ কাজ ইতিমধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে। তাছাড়াও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে কক্সবাজার ও টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের কয়েকটি পয়েন্টে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন স্থাপনের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার কাজ শুরু হয়েছে। কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে কক্সবাজার সহ সারা বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। জাতীয় কৃষিনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কৃষকের জন্য ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট। প্রায় ১ কোটি কৃষক ব্যাংক একাউন্ট খুলেছে। ১ কোটি ৪৪ জন কৃষককে কৃষি উপকরণ বিতরণ।
বেসরকারি খাতে ৪৪টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ভিশনারী’ নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। সারা বিশ্ব আজ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই অর্জন ও সাফল্যেও জন্য স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং তাঁকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ’ পদকে ভূষিত করেছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনরায়কে আমাদের পক্ষে আনতে হলে এখন থেকেই এই সব যুগান্তকারী অর্জন ও সাফল্য জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে। আসুন আজ থেকে আমরা কক্সবাজারে এই কাজটি শুরু করি।
লেখক: সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত), কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগ।